ঢাকার রাস্তায় ইদানীং নজরে পড়ছে অনেক বাইসাইকেল। মূলত তরুণ প্রজন্মের ছেলে ও মেয়েরা বেশ কিছু গ্রুপ তৈরি করেছেন যারা সাপ্তাহিক ছুটিতে শুধু সাইকেল নিয়ে ঘুরতে যান তা নয় এমনকি এখন অনেকে প্রতিদিন অফিসে যেতেও সাইকেল ব্যবহার করছেন।
বিশৃঙ্খলা আর শব্দ দূষণে জর্জরিত ঢাকা শহরে ইদানীং প্রায়শই দেখা যায় দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে দিয়েই সবাইকে পিছে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন বাইসাইকেল চালক। সেরকম একজন ঢাকার রমিত রহমান। নিয়মিত ঢাকার শঙ্কর থেকে মহাখালীতে অফিসে আসেন বাইসাইকেল চালিয়ে।
রহমান বলছিলেন, ঢাকার ভয়াবহ যানজটকে তিনি এখন নিয়মিত টেক্কা দিচ্ছেন। ‘সাইকেল চালালে যে সুবিধাটা হয় বাড়ি থেকে বের হয়ে আমাকে আর গাড়ির জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। তারপর যানজটে বসে থাকতে হয় না। সাইকেল যতদিন ধরে চালাই আমি যানজট কি ভুলে গেছি। দু’একবার বাসে চড়ে দেখেছি তখন মনে হয় এতক্ষণ ধরে রাস্তায় কেন বসে আছি!’
বাংলাদেশে একটা সময় ছিল যখন ছেলেরা একটু বড় হলেই বাইসাইকেল কিনে দেয়া হতো। পাড়ার অন্য আরো অনেকে মিলে স্কুল, কলেজে ক্লাস বা প্রাইভেট পড়তে যাওয়া অথবা ঘুরে বেড়ানো সবই চলতো বাইসাইকেলে চড়ে। ঢাকায় বেশ কিছুদিন হল নতুন করে অনেকেই দু’চাকার পরিবেশ-বান্ধব এই বাহনটি বেছে নিচ্ছেন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরাফ বিন সাত্তার বলছেন, শুধু যানজট থেকে মুক্তি নয়, বাইসাইকেল একটা দারুণ শরীর চর্চার মাধ্যমও বটে।
তিনি বলছেন, ‘নিয়মিত সাইকেলে চড়ে ক্লাস করি তাই সময়মত চলে আসতে পারি। সেই সাথে এটি চালালে এক্সারসাইজ হয়। নিজেকে অ্যাকটিভ রাখা যায়। আমরা জানি যে ব্যায়াম করলে হ্যাপি হরমোন রিলিজ হয়। তাই মনও ভালো থাকে।’
গত কয়েক বছর হল ঢাকায় মূলত আরাফ এর মতো তরুণ প্রজন্মের ছেলে ও মেয়েরা সাইক্লিস্টদের বেশ কিছু গ্রুপও তৈরি করেছেন। যারা প্রতিদিন অফিসে যেতে সাইকেল ব্যবহার করছেন বা সাপ্তাহিক ছুটিতে নিয়মিত মিলিত হচ্ছেন।
বড় কোন দিবস হলেই র্যালি করেন তারা। মেয়েদের নিয়ে গ্রুপ করে সাইকেল চালান দেবযানী মোদক। তিনি বলছিলেন, ছোট বেলায় তিনি খেলার জন্য পুতুল নয় সাইকেল চেয়েছিলেন।
তিনি বলছিলেন, ‘আমি নিজেই একা একা সাইকেল চালানো শিখেছি। কিন্তু যেহেতু ঢাকায় এখন সাইকেল নিয়ে রাস্তায় নামলে এটা সেটা শুনতে হয়, আর মেয়েদের সাইকেল চালানো দেখতে এখনো অভ্যস্ত নয় মানুষজন তাই নিরাপত্তার চিন্তাটা কিছুটা মাথায় চলে আসে। তাই আমার যেহেতু নেটওয়ার্কিং ছিল, আমি শক্তি নেটওয়ার্ক নামের একটা গ্রুপের সদস্য। সেখানে মেয়েরা মিলে আমরা একসাথে নিয়মিত সাইকেল চালাই। মাঝে মাঝে অফিসেও চলে আসি।’
দেবযানী মোদক বলছেন, তারা দল করে নারায়ণগঞ্জের পানাম নগরী, সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি কেরানীগঞ্জ পর্যন্তও গেছেন।কিন্তু ঢাকায় যারা থাকেন তাদের রোজকার অভিজ্ঞতা – চরম বিশৃঙ্খল একটি শহর ঢাকা। ট্রাফিক বিভাগের হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় এই শহরে রোজই প্রাণ হারান একাধিক পথচারী। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হারানোর ঘটনাও ঘটে নিয়মিত।
এমন শহরে বাইসাইকেল ততটা নিরাপদ নয় বলে বলছেন রমিত রহমান। তিনি বলছেন, সাইকেলের জন্যে আলাদা একটা লেন বজায় রাখতে পারলে নিরাপদ থাকা যেত। তিনি বলছেন, ‘কিন্তু ঢাকায় গাড়িতো বাদই দিলাম মানুষজনও সাইকেলকে যানবাহন বলে মনে করে না। কেউ এই বাহনকে সম্মান করে না। চালকরা লেন বদলাতে গিয়ে রীতিমতো গায়ে উঠে যায়।’
কর্তৃপক্ষ বলছে, সবাই মিলে কাজ করলে ঢাকা শহরকেও সাইকেলের জন্যে উপযোগী করে তোলা সম্ভব।
বিশ্বের অনেক দেশেই পরিবেশ বান্ধব ও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বাহন হওয়ার কারণে বাইসাইকেলকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এর জন্য রাস্তায় আলাদা লেন করা আছে। ইউরোপের অনেক দেশে বাড়িতে গাড়ি রেখে সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করছেন মানুষজন। কিন্তু ঢাকার মতো শহরে তেমন নিরাপদ পরিবেশ কি তৈরি করা সম্ভব?
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলছেন, ‘আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা সাইকেল লেন করার উদ্যোগ নিয়েছি। টিএসসি থেকে নীলক্ষেত তারপর বুয়েট হয়ে শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে আবার টিএসসি। কিন্তু ঢাকায় এটা করা খুবই চ্যালেঞ্জের বিষয়। তবে সবাই মিলে কাজ করলে এটা করা সম্ভব।’
তবে সেজন্য বসে নেই সাইকেলপ্রেমীরা। তারা মাথায় হেলমেট পরে নামছেন রাস্তায়। এমনকি হাঁটু বা কনুইয়ে লাগিয়ে নিচ্ছেন আঘাত থেকে বাঁচার আনুষঙ্গিক উপকরণ নি প্যাড বা এলবো প্যাড।
ঢাকায় দোকানও গড়ে উঠেছে অনেক। আর বেশ কিছুদিন হল বাংলাদেশ থেকে বিশ্বমানের বাইসাইকেল রপ্তানিও হচ্ছে বিদেশে।